মহাকাশের সবচেয়ে বিখ্যাত ছবির গল্প

একবার চিন্তা করুন তো, আপনার নিজের কোম্পানি কোটি কোটি বিলিয়ন টাকা খরচ করে এমন একটা যন্ত্র তৈরি করল যেটাতে অনেক ধরনের ক্রুটি আছে। আবার একটু চিন্তা করুন তো, আপনার কোম্পানি আরো অনেক টাকা খরচ করে ফেলেছে সেই ক্রুটিগুলো সারিয়ে তোলার জন্য। ঠিক এমনই একটা সময়ে আপনি যদি বলেন- আপনি এখন সম্পূর্ণ নতুন কোনো যন্ত্র বানাবেন, এতদিনের যন্ত্রটির ক্রুটি সারানোতে আর পরিশ্রম ও টাকা সরবরাহ আজ থেকে বন্ধ। ঠিক তখন কি হবে? আপনার সঙ্গে কাজ করা মানুষগুলো তাৎক্ষণিক ভাবে আপনাকে পাগল ভেবে বসতেই পারে, তাই নয় কি?

১৯৯৫ সালে ঠিক এমনই এক পরিস্থিতিতে পড়েছিলেন জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট উইলিয়াম। তিনি মহাশূন্যের এমন একদিকে হাবল স্পেস টেলিস্কোপ এর দিক নির্ণয় করেছিলেন যেদিকে কিছুই ছিল না। তবে যদি তিনি সেই সময় এমন একটা সিদ্ধান্ত না নিতেন তাহলে আজ আমাদের মহাবিশ্ব সম্পর্কে জ্ঞান কতটুকু হতো সেটা এখন প্রশ্নবিদ্ধ!

নব্বই শতকের শুরুর দিকে নাসা যখন প্রায় দেড় বিলিয়ন ডলার খরচ করে হাবল নামক এই স্পেস টেলিস্কোপ নির্মাণ করে বেশ অস্বস্তিকর এক পরিস্থিতিতে পড়েছিল, সবাই তখন বিরূপ মন্তব্য শুরু করেছিল। এমনকি হাবল স্পেস টেলিস্কোপ নিয়ে হাস্যরসাত্মক কার্টুন ছাপা হতো তখন কাগজে। এর কারণ ছিল এত টাকা দিয়ে নির্মিত এই টেলিস্কোপ থেকে যখন মহাকাশের ছবি উঠানো হয় তখন দেখা যায় যে সেই ছবি একদমই ঝাপসা, প্রায় কিছুই বুঝা যাচ্ছে না সেই ছবিতে। এই টেলিস্কোপের প্রাথমিক কাঁচ দুর্ভাগ্যবশত একদম পাতলা করে বানানো হয়। পরবর্তীতে এটা নিয়ে কমেডি মুভি ‘নেকড গান ২ ১/২’ মুক্তি পায়, যেখানে টাইটানিকের মতোই এই হাবল টেলিস্কোপকেও একটি অপ্রয়োজনীয় এবং হাস্যকরভাবে উপস্থাপন করা হয়।

পরবর্তী বেশ কয়েক বছর নাসা হাবল টেলিস্কোপের কারিগরি ক্রুটি সারানোর পিছনেও প্রচুর অর্থ এবং সময় ব্যয় করে। তারা এমন এক ধরনের কাঁচ নির্মাণ করে যেগুলো আমাদের চোখে ব্যবহৃত সাধারণ চশমার মতো সেই টেলিস্কোপে ব্যবহার করা হয় যাতে করে সেই ঝাপসা ছবিগুলো আরেকটু ভালোভাবে দেখা যায়। ১৯৯৩ সালে হাবল টেলিস্কোপটি সার্বিকভাবে কার্যকরী এবং স্পষ্ট ছবি প্রদানে সক্ষম হয়ে ওঠে।

এর ঠিক কয়েক বছর পর জ্যোতির্বিজ্ঞানী রবার্ট উইলিয়াম ঠিক করেন তিনি এই বিলিয়নস ডলার মূল্যের টেলিস্কোপটির দিক নিজের ইচ্ছে অনুযায়ী এমন মহাকাশের এমন এক দিকে ঘুরিয়ে দিতে যেখানে একদম কিছুই নেই। তিনি ১০০ ঘণ্টা ধরে মহাকাশের ফাঁকা অংশের ছবি উঠান। এরপর তিনি এমন সব গ্যালাক্সির ছবি উঠাতে সক্ষম হন যা পুরোপুরি মানুষের ধারণার বাইরে ছিল। জ্যোতির্বিজ্ঞানী উইলিয়াম আসলে দেখতে চাচ্ছিলেন হাবল টেলিস্কোপটির দৃষ্টিসীমা কতদূর পর্যন্ত যায়। আর এই নিরীক্ষণ করতে হলে এটিকে এমন একদিকে ঘুরিয়ে দিতে হবে যেই দিকে কোনো উজ্জ্বল নক্ষত্র নেই।

তার সহকর্মীরা ভাবছিলেন যে এটা একটা হাস্যকর চিন্তা, শুধুমাত্র এইজন্য নয় যে এটি তাদের অনেক মূল্যবান সময় নষ্ট করতে পারে বরং তাদের গবেষণা এমন কিছু একটা নির্দেশ করছিল যে, উইলিয়ামের এই প্রচেষ্টা সার্বিকভাবে ব্যর্থ হবে। সেই সহকর্মীরা বলছিলেন যে হাবল একটা খুবই শক্তিশালী টেলিস্কোপ কিন্তু এটা এত শক্তিশালী নয়, যা বহু দূরের গ্যালাক্সির ছবি তুলতে সক্ষম। তারা এই ধরনের কথা বলছিলেন বটে কিন্তু এমন কিছু করার চেষ্টা করেননি। বরং উইলিয়াম এটার চেষ্টা করেছিলেন এবং তিনি জানতেও চাচ্ছিলেন যে আদৌ এমন কিছু সম্ভব কি না।

‘বৈজ্ঞানিক আবিষ্কারে ঝুঁকি জরুরি’ উইলিয়াম পরবর্তীতে ন্যাশনাল জিওগ্রাফিককে বলেন। তিনি আরো বলেন যে, ‘ওই সময়ে আমি ক্যারিয়ারের এমন এক পর্যায়ে ছিলাম যে আমার এই প্রচেষ্টা যদি ব্যর্থ হতো তাহলে আমাকে পদত্যাগ করতে হতো। আমার পুরো ক্যারিয়ার ধ্বংস হয়ে যেত।’

১৯৯৫ সালের ক্রিসমাসের ঠিক আগে, উইলিয়াম এবং তার সহকারীরা মহাকাশের খুব গভীর অংশের দিকে হাবল টেলিস্কোপটির দিক নির্ণয় করেন। পরবর্তী প্রায় ১০০ ঘণ্টা ধরে নেয়া ৩৪২টি আলাদা আলাদা আলোকসম্পাত থেকে একটি ছবিতে নিয়ে আসা হয়। ‘হাবল ডিপ ফিল্ড ইমেজ’ নামক এই ছবিটিই ছিল মহাকাশে তোলা ছবির মধ্যে সবচেয়ে বিখ্যাত ছবি। এটি জ্যোতির্বিজ্ঞানের ধারণা পরিবর্তন করে দিয়েছিল।

এত ঘণ্টা ধরে ছবি তোলার কারণ হলো, হাবলের তোলা হাজার হাজার নতুন গ্যালাক্সির মধ্যে কিছু গ্যালাক্সি ছিল কোটি কোটি আলোকবর্ষ দূরে। তাই দীর্ঘ সময় ধরে ছবি উঠানো এই কারণে জরুরি ছিল যে, আমরা সাধারণত যখন আকাশের দিকে তাকাই তখন আমরা অন্ধকার দেখি কারণ আমরা আসলে কোনো কিছুর দিকেই তাকাতে পারি না। কোনো বস্তুর ওপর যখন আলো প্রতিফলিত হয়ে এরপর ফিরে আমাদের চোখে আসে তখন আমরা কোনোকিছু দেখতে পাই। আর এইসব গ্যালাক্সি এতটাই দূরে যে এতদূর আলো গিয়ে পৌঁছানোর আগেই আমাদের দৃষ্টি সরে যায় আর সেই আলো প্রতিফলিত হয়ে ফিরে আসা তো অনেক দূরের ব্যাপার। হাবল টেলিস্কোপের ডিপ ফিল্ড ইমেজে সবচেয়ে দূরবর্তী যে গ্যালাক্সিটির ছবি ধরা পড়ে সেটি প্রায় ১২ বিলিয়ন আলোকবর্ষ দূরে। সেই তুলনায় পুরো মহাবিশ্বই ৩.৮ বিলিয়ন বছর পুরোনো। হাবল এর তোলা ডিপ ফিল্ড ইমেজ থেকে বিজ্ঞানীরা পরবর্তীতে কম বয়সি নতুন গ্যালাক্সি নিয়ে গবেষণা করে বুঝতে সক্ষম হোন যে, একেকটা গ্যালাক্সি কীভাবে গঠিত হয়।

Comments

Popular posts from this blog

ওয়ালটন বাজারে ছাড়লো দেশে তৈরি প্রথম ফিচার ফোন

যাকে নিয়ে আজকের ডুডল

‘আমার জীবন রক্ষা করেছে স্মার্টওয়াচ’